ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় রাত পৌনে ১টা বাজে । ক্রিং ক্রিং ক্রিং করে ড্রইং রুমে ফোনটা
অনেকক্ষন ধরে বাজছে । এই শীতের রাতে ফোন ধরার কোন ইচ্ছেই শান্তুর নেই । শান্তু
মনে মনে ভাবছে যেই ফোন করুক, ভোরে কলার আইডি দেখে কল ব্যাক করা যাবে । শান্তু
এখন মনে প্রাণে চাইছে যে, ফোন বাজাটা বন্ধ হয়ে যাক । এমনিতেই
শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে গেছে, তার উপড়ে ভোরে অফিস
ধরতে হবে । এতো রাতে ফোন ধরার কোন মানে হয় না ।
শান্তু কম্বল দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলে । কিন্তু তবুও ফোনের একঘেয়ে ক্রিং ক্রিং শব্দটা ওর মাথায় গিয়ে লাগে । ও
চিৎকার করে বলে উঠে উফ…. অসহ্য ! অসহ্য ।
যে ফোন করেছে সেও যেন নাছড়বান্দা,
যেন পণ করে বসে আছে , এ প্রান্ত থেকে কেউ ফোন
না ধরা পর্যন্ত রিং করেই যাবে । শান্তু নিজেকে আর
কম্বলের নীচে আটকে রাখতে পারে না । যন্ত্রনারে, যন্ত্রনারে
বলতে বলতে বিছানা থেকে উঠে যায় । বিছানা
ছেড়ে উঠতে উঠতে শান্তু মনে মনে ঠিক করে উল্টা পাল্টা ফোন হলে -যেই করুক চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়বে ।
গভীর রাতের ফোন গুলো সাধারনত হয় শোক
সংবাদের, নয় তো উল্টা পাল্টা । কেউ মারা গেলে অথবা
অসুস্থ্য হলেই আত্মীয়-স্বজনরা গভীর রাতে একে অপরকে ফোন করে । তবে বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় যে, এ যুগের কোমড়ের নীচে প্যান্ট পরা চেংড়া চেংড়া সব পোলাপান উল্টা পাল্টা ডায়াল খেঁজুরা আলাপ করার জন্য
মেয়েদের খুঁজে বেড়ায় ।
শান্তু মনে মনে নিজেকে একরকম তৈরি করেই
ড্রইং রুমে দিকে রওনা দেয় । ও ধরেই নিয়েছে যে, এটা
উল্টা পাল্টা ফোন ছাড়া আর কিছুই হবে না । ড্রইং রুমের দিকে
যেতে যেতে শান্তুর একবার মনে হয়,
দেখা যাবে যেই ও ফোনের কাছে গিয়ে
দাঁড়াবে ওমনি ফোন বাজা বন্ধ হয়ে যাবে । কপাল কুচকে ড্রইং রুমের বাতিটা জ্বালিয়ে শান্তু ফোনের সামনে এসে দাঁড়ায় । দুই
সোফার মাঝখানে রাখা ফোনটা তখনও বেজে চলেছে
। সোফায় বসে, শান্তু
রিসিভারটা তুলে নিয়ে বলে – হ্যালো, কে বলছেন ? কয়েক
মুহুত কেটে যায় ।
অপর পাশ থেকে কোন শব্দ নেই । শান্তু আবারও বলে – হ্যালো,
কে বলছেন ? ওপর পাশে থেকে এবারও কেউ
উত্তর দেয় না । এবার শান্তু বিরক্তি আর চেপে রাখতে
পারে না – প্রায় চিৎকার করে বলে – আরে
কথা বলছেন না কেন ? বেশ কিছুক্ষন চুপ
করে কানে রিসিভার ধরে রাখার পর শান্তুর
মনে হলো, অপর পাশে কেউ একজন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ।
শান্তু আবারও বলে উঠে – হ্যালো ! হ্যালো ! আশ্চর্য কথা বলছেন না কেন ? কথা না বললে এতো রাতে ফোন
করেছেন কেন ? যতোসব যন্ত্রনা । ওপর
পাশে থেকে আবার ও দীর্ঘশ্বাস ফেরার শব্দ
ভেসে এলো । শান্তু আবার বললো – হ্যালো ! হ্যালো ! হঠাৎই
ডায়াল টোন ফিরে আসাতে শান্তু রিসিভারটা প্রায় আছড়ে রেখে বলে উঠলো – যতোসব নরকের কীট ।
শান্তুর চোখ থেকে ঘুম পুরোপুরি সড়ে গেছে
। সোফা থেকে উঠে ওর রুমে যাবার জন্য
যেই না মাঝখানে ডাইনিং রুমের দরজায় তাকিয়েছে, ওমনি
কয়েক মুহুর্তের জন্য চমকে উঠলো
শান্তু – ওর মনে হলো চট করে কে যেন সড়ে গেল । শান্তুর পুরো শরীর
হঠাৎ কেঁপে উঠলো । সমস্ত শরীরে একটা শিরশির অনুভুতি ভয়ে
গেল । শান্তুর মনে হলো,যে কেউ একজন দরজায় দাড়িয়ে ওকে দেখছিল । ও
তাকাতেই যেন চোখের পলকে শূণ্যে একটা অবয়বটা
মিলিয়ে গেল । শান্তুর পুরো শরীর ঝিম ঝিম করেছে । কেউ আছে কিনা, ভাল করে দেখার জন্য শান্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইনিং রুমের
বাতিটা জ্বেলে দিল । মুর্হুতে পুরো ড্রাইনিং রুমটা আলোকিত হয়ে গেল । ড্রাইনিং টেবিল, চেয়ার, ফ্রিজ, ফ্রিজের উপড় রাখা বিভিন্ন বোতলগুলো যেন ওর দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গাত্নক হাঁসি হাসতে লাগলো ।
এছাড়া আর কোথাও কেউ নেই । নির্ঘাত চোখের ভুল বলে , মন
থেকে শান্তু ব্যাপারটা সড়িয়ে দিতে চেষ্টা করলো । কিন্তু ও’র অবচের্তন মন
ব্যাপারটা ভুলতে পারলো না ।
শান্তু ড্রাইনিং টেবিলের নীচটায় একবার
তাকিয়ে দেখলো, কেউ লুকিয়ে আছে কিনা ,
তারপর যেই বাতি নেভাবার জন্য সুইচে হাত
দিয়েছে, ঠিক তখনই ক্রিং ক্রিং করে ফোনটা আবারো বেজে উঠলো । হঠাৎ শব্দে শান্তু
প্রায় চমকে উঠলো । বুকটা ধকধক করছে । রাতের বেলায় সব শব্দ
বুঝি একটু জোড়ে শোনা যায় ।
শান্তু নিজেকে শান্ত রেখে থু থু করে
বুকে দু’বার থুতু দিল ।তারপর
ফোনের রিসিভারটা তুলে বললো – হ্যালো ! কে ? এবার
অপর পাশে থেকে শো শো শব্দ শোনা গেল
। ঝড় হলে দরজা জানালা বন্ধ থাকা ঘরের ভেতর থেকে যে রকম শব্দ শোনা
যায়,অনেকটা
সে রকম । এ ছাড়া অপর পাশে অন্য কোন শব্দ নেই । শান্তু তবুও বেশ বিরক্তি
নিয়ে বললো -এতো রাতে ফোন করে বিরক্ত করার মানে কি ? কথা বলছেন না কেন
? হ্যালো! হ্যালো! । হঠাৎ
ফোনের শো শো শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল । এবং আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা গেল ।
আরে ব্যাটা ছাগলের মতো খালি খালি
দীর্ঘশ্বাস ছাড়রস কেন ? বাপের ব্যাটা হলে
কথা বল । অন্যদিক
দিয়ে দম বেড় করে দিমু । যতোসব ইডিয়টের দল । খুঁট
করে ফোন রেখে দেবার শব্দ হলো ।
শান্তু রাগে গজগজ করতে করতে কলার
লিষ্টটা দেখলো ০০ দিয়ে একটা অপরিচিত নাম্বার
উঠে আছে । হঠাৎ শান্তুর মনে হলো কোন ওভারসিস কল
নাতো ? ওভারসিস কল হলে, নরওয়ে থেকে একমাত্র
বড়মামা ফোন করতে পারে । কিন্তু মামা তো জানে মা -বাবা, টুম্পা সবাই সিলেট
গেছে । তাহলে ! কে ফোন করলো ? এভাবে
গালি দেওয়া কি ঠিক হলো ?
কথাটা চিন্তা করতে করতে বার্থরুম হয়ে,
শান্তু ওর ঘরে চলে এলো ।
কম্বল টেনে শুতে শুতে শান্তু ঘড়ি দেখলো ,
পৌনে দুটো বাজে । মনে
মনে দোয়া পড়ে শান্তু ডানপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো ।
দুই
শান্তু কতোক্ষন ঘুমিয়েছে ঠিক বলতে পারবে
না । ঘুম ভাঙ্গল কোন কিছুর খুঁটুর
মুঁটুর শব্দে । শান্তু মাথা তুলে শুনতে চেষ্টা করলো
শব্দটা কোথা থেকে আসছে । শান্তু
ওর ঘরের বাতি জ্বেলেই শুয়েছে । দরজা খোলা থাকায়
ড্রাইনিং রুমের ফ্রিজ দুটো স্পস্ট দেখা
যাচ্ছে । নরমাল ফ্লিজটার গা ঘেষেই রান্না ঘর – শান্তুর
হঠাৎ মনে হলো-রান্না ঘরে কেউ একজন কিছু একটা করছে । খুঁটুর খুঁটুর শব্দটা রান্না ঘরে থেকেই আসছে ।
এতো রাতে কে হতে পারে ? যেহেতু পুরো বাসায় শান্তু একা । তাহলে
রান্না ঘরে কে ? শান্তু
বেশ ঘাবড়ে গেল । কে আসবে এতো রাতে রান্না ঘরে ? ভূতটুত না তো ? ড্রইং
রুমের দরজায় দেখা অবয়বটার কথা মনে পরে গেল শান্তুর । কেমন
একটা ভয়ে পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো । শান্তু কম্বলটা গাঁ থেকে সড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো । ভয়টা যাচ্ছে না । শান্তু গলা খাকারি দিয়ে বললো -কে ? কে ওখানে ? প্রায়
সঙ্গে সঙ্গে খুঁট খুঁট শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল ।
শান্তু ওর ঘর থেকে পুরোপুরি না বেড় হয়ে
রান্না ঘরের দিকে উকি দিল । ঠিক তখনি ওর মনে হলো, রান্না
ঘরের দরজা থেকে কেউ একজন হুট করে সড়ে গেল । শান্তু চমকে উঠে বেশ ঘনঘন বলে উঠলো- কে ? কে ?
রান্না ঘরটা বেশ অন্ধকার কিছুই দেখা
যাচ্ছে না । শান্তু রান্না ঘরে না গিয়ে ড্রইং রুমের দিকে গিয়ে ড্রইং রুমের বাতিটা জ্বালাল । ভয়ে এর পুরো শরীর কাঁপছে
। ড্রইং রুমের বাতিতে রান্না ঘরের অন্ধকারটা কিছুটা কেটে গেল । শান্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ ভয়ে ভয়ে
রান্না ঘরে উকি দিল । না । কেউ
নেই । রান্না ঘরের বাইরে থেকেই শান্তু একটু
ঝুকে রান্না ঘরের বাতিটা জ্বালাল । না
। আসলেই কেউ নেই । শান্তু বেশ
স্বস্থ্যিবোধ করলো । শুধু শুধু ভয় পাবার জন্য নিজেকে শান্তু ধিক্কার দিলো, এই বলে যে, ব্যাটা
শান্তু , তুই একটা ভীতুর ডিম। বাবা, মা, আর টুম্পা যদি তোমার
এই সাহসের কথা জানতে পারে তা হলে আর
দেখতে হবে না । তোমার সাহসের কথা আত্মীয় স্বজনসহ
চারিদিকে রাষ্ট্র হয়ে যাবে । রান্না ঘরের বাতিটা নিবিয়ে, শান্তু
রান্না ঘরের পাশের বার্থরুমে ঢুকলো পেশাব করার
জন্য ।
বাসায় কেউ না থাকলেও শান্তু বার্থরুমের
দরজাটা একটু চেপে দিল । পেশাব প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় ও আবারও খুটুর খুটুর শব্দটা শুনতে পেল । ওর মনে হলো কেউ
যেন ইচ্ছে খুটঁ খুঁট খুঁট করে মাত্র তিনটা শব্দটা করলো । এমন
করে শব্দটা করলো যেন শান্তু শুনতে পায় ।
ভয়ে আবারও ওর শরীর ঝিম ঝিম করে উঠলো । শান্তু মনে মনে ভাবলো ভূত টুত নাতো ? কিন্তু পরক্ষনেই ভূতের চিন্তাটা মাথা থেকে বাদ দিয়ে ও
বার্থরুমেই অপেক্ষা করতে লাগলো আরো শব্দ
শুনার জন্য । কিন্তু না, আর কোন শব্দ হলো না । বেশ কিছুক্ষন বার্থরুমে অপেক্ষা করে শান্তু ওর রুমে চলে এলো ।
বার্থরুম থেকে বেড় হয়ে ওর রুমে আসার সময়
শান্তু ইচ্ছে করেই রান্না ঘরের দিকে
তাকালো না । ওর হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, রান্না ঘরের দিকে তাকালে ও ভয়ণ্কর
কিছু একটা দেখতে পাবে । ড্রাইনিং এর বাতি না নিভিয়েই শান্তু ওর
রুমে চলে এলো । নানান
আজে বাজে চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । নিজ বাসায় এমন
পরিস্হিতির সন্মুক্ষিন হতে হবে ও কখনও
তা কল্পনাও ভাবতে পারেনি ।
যদিও শান্তু নিজেকে বুঝাতে চেষ্টা করে
যে, ভয় পাবার কোন কারন নেই । সব হচ্ছে মনের ভুল । কিন্তু তবুও ভয় যাচ্ছে না । বরং
একটু একটু করে অজানা ভয়টা ওকে আরো জড়িয়ে ধরে । আসলে ভয় ব্যাপারটাই এমন, একবার
কেউ ভয় পেতে শুরু করলে ভয়টা আস্তে আস্তে
বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে । শান্তু
বিছানায় শুয়ে পুরো ব্যাপারটা বিশ্লেষন
করতে শুরু করলো । ওর ধারনা তাতে ভয় ব্যাপারটা চলে যাবে । ওর বিশ্লেষনের প্রদ্বতিটা হচ্ছে নিজের
সঙ্গে মনে মনে কথা বলা । শান্তু ওর বিশ্লেষন শুরু করলো -
“মিয়া শান্তু তুমি ভয় পাচ্ছো কেন ?”
“আমি ভয় পাচ্ছি না ।”
“ইমহু….নিজের
সঙ্গে মিথ্যা চলে না । ডাক্টার,উকিল
আর নিজের সঙ্গে মিথ্যা বলতে নেই মিয়া । তুমি এই মুর্হুতে ভয়ে কেঁচো হয়ে আছো । কি
ভয় পাচ্ছো না ?”
“তা, কিছুটা
ভয় পাচ্ছি ।”
“কেন পাচ্ছো ?”
“জানিনা ।”
“আবারও মিথ্যা ? ইমহু…. ঝেড়ে কাশ মিয়া । ঝেড়ে কাশ। তারপর টুক করে সত্যটা
বলে ফেলো । বিশ্লেষন
করতে বসে মিথ্যা বললে তো কোন কাজ হবে না ।”
“আমার মনে হচ্ছে, এই মূহুতে আমি ছাড়াও
এ বাসায় কেউ একজন আছে ।” বলতে বলতে শান্তু টের পায় ও’র
মধ্যে আমারও সেই জিম ধরানো ব্যাপারটা চলে এসেছে । মাথার
পেছনের চুলগুলো আপনা আপনা একটু একটু করে
দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ।
“কে আছে ?”
“আমি জানিনা ?”
“কিভাবে বুঝলে যে তুমি ছাড়াও বাসায় আরো
কেউ আছে ?”
“ড্রইং রুম থেকে ফোন রেখে ফেরার সময় মনে
হলো – কেউ একজন হুট করে সড়ে গেল । রান্না ঘরের দরজায় ও একই ব্যাপার ঘটলো ।”
“এটা তোমার মনের ভুল । বিজ্ঞান বলেও তো একটা বিষয় আছে মিয়া । হঠাৎ
আলো থেকে অন্ধকারে তাকালে এমনটা হতে পারে । সবই আলোর খেলা ।”
“কিন্তু, একটু
আগে যে, রান্না ঘর থেকে খুটুর খুটুর শব্দ শুনতে
পেলাম । সেটাও কি মনের ভুল ? নাকি সেটাও আলোর খেলা ?”
“না ,সেটা
মনের ভুল বা আলোর খেলা না । সেটা হলো ইঁদুরের
খেলা । তুমি কি রান্না ঘরে কাউকে দেখতে পেয়েছো ?”
“না ।”
“তাহলে, তো
শব্দটা ইদুঁরই করছে, নাকি ?” শান্তু যুক্তিটা একেবারে উড়িয়ে দিতে না পারলেও বললো- “আমাদের বাসায় কোন ইঁদুর নেই ।”
“তুমি কি বিলাই নাকি মিয়া ? যে জান, বাসায় কোন ইঁদুর নাই । ইঁদুরের খবর জানে বিড়াল ।”
“না, তা
ঠিক না ।”
“শুন মিয়া, সব তোমার মনের ভুল । আসলে বাসায় তুমি ছাড়া
আর কিছুই নাই । সব তোমার মনের ভুল । কম্বলমুড়ী দিয়া ঘুমাও । আমি তা হলে আসি ।”
শান্তু নিজের অজান্তেই মাথা নাড়লো । নিজের সঙ্গে ভয় বিষয়ক বিশ্লেষনে শান্তুর ভয়টা অনেকাংশে কমে যায় । চোখেও
ঘুম চলে এসেছে । শান্তু কম্বলটা গলা পর্যন্তটেনে যে ই পাশ ফিরে শুয়েছে, ওমনি কুট করে ড্রাইনিং এর টিউব লাইটা আপনা আপনি নিবে গেল । সঙ্গে সঙ্গে শান্তুর
পুরো শরীর ভয়ে আবার ও শক্ত হয়ে গেল
। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা শিরশির অনুভুতি খেলে গেল । শান্তু চুপ করে বিছানায়
পড়ে আছে কি হয় দেখার জন্য । কয়েক মূর্হুত কোন
কিছু হলো না । ড্রইং রুম
থেকে দেয়াল ঘড়ির টিক টিক শব্দটা শুনা যাচ্ছে । কিছুসময়
পর আবারও রান্না ঘর থেকে খুঁটুর মুঁটুর শব্দটা
শোনা গেল ।
তবে এবারের শব্দটা শান্তুর মনে হলো আগের
চেয়েও একটু বেশি জোড়ে হচ্ছে । যে শব্দটা করছে তার মধ্যে কোন রাখ- ঢাকের ব্যাপার নেই । যেন কে, শব্দ শুনলো আর
কে, না
শুনলো তাতে তার কিচ্ছুই যায় আসে না । শান্তু কি করবে বুঝতে
পারছে না । শব্দের
পরিমান একটু একটু করে বাড়ছে । শান্তু হঠাৎ বলে
উঠলো- কে রে ?
সঙ্গে সঙ্গে খুঁটুর মুঁটুর শব্দটা বন্ধ
হয়ে গেল । শান্তু কি করবে বুঝতে পারছে না । বিছানায় আধশোয়া হয়ে
আছে । মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ে বুকে ফুঁ’দিল । কি
দোয়া পড়লো নিজেও বুঝলো না । ভয়ের সময় সব তালগোল
পাকিয়ে যায় । শান্তু ঠিক
করলো, যা হোক হবে ও একদৌড়ে রান্নাঘরে যাবে । আজ দেখতেই হবে রান্না ঘরে কে
? পাজলামোর একটা সীমা আছে । এটা তো দেখছি দুনিয়া ছাড়া ফাজলামো । ভয়
পেলেই ভয় । রান্না
ঘর থেকে আর কোন শব্দ শুনা গেল না । শান্তু কান খাঁড়া করে
বিছানায় আধ শোয়া হয়ে আছে ।
শীতের এই রাতেও ও টের পেল যে, ও দরদর করে ঘামছে । ড্রাইনিংয়ের বাতিটা
বারদুয়েক ফুরুত ফুরুত করে জ্বলে উঠে
আবারও নীভে গেল । শান্তু ওর ঘরের দরজাটা দিয়ে রান্না ঘরের দিকেই তাকিয়ে আছে ।
কিছুসময় পর আবার শুরু হলো খুঁটুর মুঁটুর
শব্দ । শান্তু এক ঝারা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো
, এদিক সেদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজলো,
সঙ্গে নেবার জন্য । কিন্তু
কিছুই পেল না । মনে
মনে বিরক্ত হলো, এই ভেবে যে, সময় মতো খুঁজলে কিছু পাওয়া যায়
না । শেষমেস আলতো কম্পিউটার টেবিল এর ড্রয়ারটা খুলে, একটা প্লাস পেয়ে সেটাই
হাতে নিয়ে ওর ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল । শান্তু এবার নিশ্চত
হলো যে, রান্না
ঘর থেকে খুঁটুর মুঁটুর শব্দটা আসছে । তবে এখন মনে হচ্ছে
শব্দটা বেশ আস্তে আস্তে হচ্ছে ।
শান্তু দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে
চারটা বাজে । তারপর খুব আস্তে আস্তে রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো, রান্না ঘরের ভেতরে উকি দিতেই ও যা দেখলো তাতে ওর পুরো শরীর অবস হয়ে এলো । বিস্ময়ে
ওর মনে হলো মাথা ঘুরে পরে যাবে । নিজের
চোখকে বিশ্বাষ হচ্ছে না । ও দেখলো রান্না ঘরে
একটা মেয়ে বসে একাগ্র মনে পাটাতে কিছু একটা
বাটছে । আবচ্ছা আলোয় মেয়েটা মুখটা দেখা যাচ্ছে
না । ঘারের দু’পাশে আর পিঠে ঘনকারো চুল গুলো ছড়ানো রয়েছে । পাটার ঘষাতে ঘষাতে খোলা
চুলগুলোসহ মেয়েটার মাথাটা সামনে পিছে দুলছে । শান্তু
মুখ দিয়ে অর্স্পষ্ট ভাবে বেড় হয়ে এলো – কে ?
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা শান্তর দিকে ঘুরে
তাকায়, মেয়েটার চুলের ফাঁক দিয়ে সাদা ডিমের মতো দু’টো
চোখের চাহনী দেখে শান্তু’র ভেতটা পর্যন্তু
কেঁপে উঠলো । হিষ্টিরিয়ার রোগীর
মতো ও কোন মতে তোতলাতে তোতলাতে প্লাস ধরা হাতটা তুলে ধরে লাফাতে লাফাতে বললো কে ? কে
? শান্তুর পুরো শরীর ওর থরথর করে কাঁপতে
শুরু করে । চোখে
ঠিক মতো কিছু দেখছে না । হঠাৎ ওর মনে হলো ওর
হার্ট আট্যাক হয়ে যাবে ।
রান্না ঘরে পাটাতে বসা মেয়েটা কোন কথা
বললো না , শুধু শান্তুর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় । মেয়েটার মুখটা নীচের দিকে করা
কিন্তু চোখ দুটো উল্টো করে শান্তুর দিকে কঠিন চেহারা করে তাকিয়ে আছে । সেই চোখে কোন মনি নেই । কারো চোখ যে, এতো
ভয়ন্কর হতে পারে তা শান্তুর কল্পনাতেও ছিল না । মেয়েটার ভয়ন্কর চাহনির কাছে শান্তু হঠাৎ যেন আরো বেশি অসহায় হয়ে পরে । মেয়েটার গাল বেয়ে
বেয়ে পচাঁ ,গলা মাংস খসে খসে পরছে । মেয়েটা মুখে পশুর মতো ক্যামন একটা
গগগগগগর শব্দ করতেই শান্তু লাফাতে লাফাতে বলে-
যা, যা । তারপর
হাতে থাকা প্লাসটা মেয়েটার দিকে ছুড়ে মারে । মেয়েটার ভেতর দিয়ে প্লাসটা উড়ে গিয়ে রান্না ঘরের জানালায় লাগাতে
জানালার কাঁচগুলো ঝনঝন করে ভেংগে পরে ।
শান্তুর এ ব্যর্থতায় মেয়েটা যেন আরো
বেশি হিংস্র হয়ে উঠলো । চোখে মুখে কেমন একটা ভয়ন্কর হাসি ফুঁটিয়ে মুখে ঘঘঘঘঘঘরর শব্দ করে শান্তুর দিকে
ছুটে আসে । হুঁট করে শান্তু ছুটে
পালানোর জন্য পেছন ঘুরে দৌড় দেবার জন্য ঘুরতেই ওর রুমের
দরজার সঙ্গে প্রচন্ড আঘাত খেয়ে ছিটকে পড়লো মাটিতে । এবং
জ্ঞান হারিয়ে ফেললো ।
পরিশেষ : শান্তুর
ছুড়ে মারা প্লাসের আঘাতে রান্না ঘরের কাঁচ ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে পরাতে পুরো বিল্ডিয়ের লোকজন জেগে
উঠে । নীচ থেকে সিকিউরিটি গার্ডসহ বাড়ীওয়ালা এসে
অনেকক্ষন বেল বাজানোর পরেও শান্তু দরজা না খুলায়, সবাই দরজা ভেঙ্গে শান্তুকে মাটিতে পর অবস্থায় পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে । যেখানে সপ্তাহ্ খানেক কোমাতে থাকার পর শান্তু
মারা যায় । আর, শান্তুর মৃত্যটা রহস্য হয়ে ঐ বাড়ীর
দেয়ালে দেয়ালে হাহাকার করতে থাকে ।